করোনা ভাইরাসের নতুন একটি ধরন সনাক্ত হয়েছে বেশ কিছুদিন হলো। যার বৈজ্ঞানিক নাম বি.১.১.৫২৯ বা ওমিক্রন । উদ্বিগ্ন হয়ে পরেছে গোটা বিশ্ব। নানা নিষেধাজ্ঞা এবং সতর্কতা জারি হয়েছে উন্নত রাষ্ট্রগুলোয়। সংক্রমিত হচ্ছে আগের চেয়েও বেশি হারে। দক্ষিণ আফ্রিকার একটি প্রদেশে করোনার জিনগত মিউটেশনে বিশ্বজুড়ে নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে এমন শঙ্কাময় পরিস্থিতি। বাংলাদেশেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জারি করেছে ১৫ দফা সতর্কতা। সরকার বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে জানুয়ারি থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বর্ধিত সময়। গণপরিবহন, হাট-বাজার ও রাস্তাঘাটসহ ঘরের বাইরে বের হলেই স্বাস্থ্য বিধি পালনের জোর তাগিদ দেওয়া হলেও কারো কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। অনিহা-অনাগ্রহে স্বাস্থ্য বিধি উপেক্ষিত হওয়া এই গৌরচন্দ্রিকার কারন।
গত বছরের শুরুর দিকে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পরলে বিশ্বের নানা প্রান্তে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়। আহ্বান জানানো হয় সামাজিক দূরত্বের। বাধ্যতামূলকভাবে এ ভূখন্ডেও অচল পরিস্থিতি বরণ করেছিলো। কলকারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি কোম্পানির ছাটাইয়ের কবলে পরে বেকারত্বের মুখোমুখি দাড়িয়েছিল অসংখ্য মানুষ। বন্ধ ছিলো রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ। কেবলমাত্র অপেক্ষা ছিলো আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুর সাইরেন শোনা। বিদেশ ফেরত অনেক প্রবাসী আর ফিরে যেতে পারেনি। চাপে-বিপাকে, উৎপাদন সংকটে নানান জটিলতা আছড়ে পরে দ্রব্যমূল্যের উপর। সংকটকালীন এই সময়ে প্রবাসীদের সঞ্চয় রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতি সামাল দিয়েছে। জনজীবনে হাপিত্যেশ উঠেছিলো– কবে সবকিছু আবার স্বাভাবিক হবে? করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শেষে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হয়েছিলো। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো অর্থনীতি। যদিও ততদিনে আমাদের অপূরনীয় ক্ষতি হয়ে গেছে!
অতিমারী কালীন সময়ে জোর দেওয়া হয়েছে অনলাইন শিক্ষণ কার্যক্রম। শহরের এবং উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইনের আওতায় আসলেও সক্ষমতা ছিলো না প্রান্তিক পর্যায়ে। পরিণামে শহর এবং গ্রামের ভিতরে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত বৈষম্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পরে বাস্তবে দেখা গেল– নীতি নির্ধারকদের ভুলের মাশুল দিতে ভুক্তভোগী হয়েছে গরিব পরিবারগুলো। ঝরে পরেছে গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষার্থী। দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সশরীরে পড়াশোনার কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আগ্রহ হারিয়েছে কেউ কেউ। মেয়েরা শিকার হয়েছে বাল্যবিবাহের। গণমাধ্যম মারফত প্রকাশিত হলো বিয়ে হয়ে যাওয়ায় কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার মতো কেউ ছিলো না।
করোনা প্রতিরোধ করতে আগে ভ্যাকসিন পেয়েছে উন্নত দেশগুলো। এমনকি কিছু সংখ্যক রাষ্ট্রে ইতোমধ্যে বুস্টার ডোজ দেওয়া শেষ। যেখানে অনুন্নত দারিদ্র্য রাষ্ট্রগুলো প্রথম ডোজ দেওয়াই এখনো শেষ করতে পারেনি। তাহলে দারিদ্র্য দেশগুলোকে পিছনে ফেলে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো নিজেরা ভ্যাক্সিন নিশ্চিত করে ঝুঁকিমুক্ত হতে পারলো? পারলো না, বরং স্পষ্ট হয়ে উঠলো– পিছিয়ে পরা দারিদ্র্য ঐ সকল দেশ থেকেই বারবার মিউটেশন হচ্ছে, অতঃপর পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পরছে এবং আগের টিকা অকার্যকর। এতেই প্রমাণিত হয় সামষ্টিক লড়াই ছাড়া করোনা ভাইরাস অপ্রতিরোধ্য।
পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে ক্রমেই ছড়িয়ে পরেছে ওমিক্রন। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। সব মিলিয়ে ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছে ৪৫টির অধিক দেশ। অসহায় হয়ে পরেছে সেখানকার নাগরিকেরা। ওমিক্রন ধরা পরেছে বাংলাদেশেও। অথচ ব্যক্তি পর্যায়ে আমাদের কোন খেয়াল নেই, উদ্বেগ নেই। যে যার মতো লাগামছাড়া। একরকম খাপছাড়া পরিস্থিতি চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রক্ষায় হয়তো আবার স্কুল কলেজ বন্ধের সিদ্ধান্তে আসতে হবে। বিপরীতে বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরে ন্যায়সঙ্গত কারণেই হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার তুমুল বিরোধিতা। লকডাউনে না গেলেও অর্থনীতি এবার সামাল দেওয়া চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে নিশ্চিত। চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে করোনায় ভঙ্গুর শিক্ষা ব্যবস্থা কাটিয়ে উঠতে। সবক্ষেত্রেই প্রযুক্তির শতভাগ সদ্ব্যবহারের প্রস্তুতি রাখা এখন গুরুত্বপূর্ণ।
করোনা আক্রান্তের পর থেকে অসংখ্য মৃত্যু দেখেছে বাংলাদেশ। তৃতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণ ঠেকাতে ঢালাওভাবে নিষেধাজ্ঞা কেবল বিলম্বিত করতে পারবে; কিন্তু প্রান্তিক পর্যায় থেকে নাগরিক সতর্কতা অবলম্বন না করলে ঠেকানো সম্ভব নয়। জীবনের উপর মহামূল্যবান কিছু নাই। সুতরাং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধকরণ ছাড়া তখন বিকল্প কোন উপায় থাকবে না। নাগরিক গণসচেতনতা জোরদার প্রত্যাশিত। ভবিষ্যৎ সুরক্ষা আমাদের সামষ্টিক আচরণের উপর নির্ভর করছে।
সজীব ওয়াফি
প্রাবন্ধিক, ঢাকা
Leave a Reply