ফিলিস্তিন ইস্যুতে গেল বছর এই প্রবন্ধটি লিখেছিলাম, এরিখ মারিয়া রেমার্কের চোখে যেখানে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছিলাম যুদ্ধের বাস্তবতা ও তার পরিণতি। আমি না ইউক্রেনের পক্ষপাতী না রাশিয়ার, আমি ব্যস আধিপত্য বিস্তারের নামে সব যুদ্ধেরই বিরুদ্ধে। আমার মতবিশ্বাসের দলিল এই প্রবন্ধটি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিতে লেখা ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ বইয়ের এই পর্যালোচনাটি আপনার চিন্তার গতিপথে নতুনত্ব জোগাবে, আমি এমনটিই আশা করি- মওলবি আশরাফ
(ক)
‘যুদ্ধ’— কেবল একটি শব্দ নয়, লাখো কোটি মানুষের সুখময় জীবন জাহান্নাম করে দেওয়া, মানবের হাতে তৈরি সর্বধ্বংসী মানবতাহীন অস্ত্রের প্রয়োগ, পাশবিক ও পৈশাচিক উল্লাসের এক রক্তাক্ত আখ্যান। অথচ এ এমন এক বাস্তবতা, যত এড়িয়ে যেতে চাই, বারবার হুমড়ি খেয়ে পড়ি এর মাঝে।
ডিসেম্বর ১৯৩০, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ১২ বছর পরে বার্লিনের মোৎজার্ট হলে হলিউডের সর্বশেষ মুক্তি পাওয়া একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হচ্ছিল। এমন সময় হলে চীৎকার করে কেউ একজন বলে উঠল ‘য়ুদেনফিল্ম’, মানে ইহুদিদের সিনেমা, অমনি পুরো হলজুড়ে চিৎকার-চেঁচামেচি আর বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে গেল। সেদিনকার প্রদর্শিত সিনেমাটি ছিল বিখ্যাত জার্মান ঔপন্যাসিক এরিখ মারিয়া রেমার্কের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’। যেই উপন্যাসে রেমার্ক তার সৈনিক জীবনকে চিত্রায়িত করেছিল । আর পৃথিবীকে আহ্বান জানিয়েছিল ভবিতব্য অন্যায় যুদ্ধের অবসান ঘটাতে। কিন্তু যুদ্ধবাজ রক্তপিপাসু মানুষজাতি কি আর সেই শান্তির ডাক শুনে?
রেমার্ক ছিলেন ফরাসি বংশোদ্ভূত জার্মান সাহিত্যিক। ১৮৯৮ সালের ২২ জুন জার্মানির ওয়েস্ট ফেলিয়ার ওসনাব্রায়কে তার জন্ম। মাত্র আঠারো বছর বয়সে, ১৯১৬ সালে, রেমার্ককে বাধ্যতামুলকভাবে যোগ দিতে হয়েছিল জার্মান সেনাবাহিনীতে। জুন ১২, ১৯১৭তে তাকে পাঠানো হয় ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে, দুই নম্বর কোম্পানিতে। সেখানে তিনি বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নেন। খুব কাছে থেকে দেখেন প্রথম যুদ্ধের বিভৎসতা আর ধ্বংসযজ্ঞ। বোমা বিস্ফোরণে বাম পা, ডান হাত আর ঘাড়ে মারাত্নক জখম হলে, তাকে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় জার্মানের এক সামরিক হাসপাতালে। যুদ্ধের বাকিটা সময় তিনি সেখানেই ছিলেন।
(খ)
ভাগ্যাহত এক জার্মান তরুণ ‘পল বোমার’, নিজের অতীত ও ভবিষ্যতকে গলা টিপে হত্যা করে তাকে যেতে হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। পরিস্থিতি কুড়ি বছর না-পেরোনো তরুণকেও বানিয়ে দেয় বয়োবৃদ্ধের মতো বিজ্ঞ। আপন সত্তার দ্বান্দ্বিকতায় বেকারার হয়ে পড়ে সে। আপন মনে বলে, ‘এই যে যাদের গুলি করে কিংবা গোলা মেরে হত্যা করছি তাদের সাথে আমাদের কীসের শত্রুতা? রাজায় রাজায় দ্বন্দ্ব, রাজার ক্ষমতা আর ‘গ্রেট’ হওয়ার লোভ—“কোথায় কবে কোন টেবিলে একটা কাগজে স্বাক্ষর হলো, আমরা জানলাম না ওরা জানল না, অমনি আমাদের জীবনের লক্ষ্য হয়ে উঠল একে অন্যকে ধ্বংস করা। আমরা এতদিন একসাথে থাকলাম, সে পরিচয় মুছে গেল এক নিমিষে।”
“আমাদের চিন্তা-ভাবনাগুলো যেন একতাল কাদা। সারাক্ষণ বদলে যাচ্ছে। যখন মানুষ মারি, তখন মনে হয় এটাই ঠিক, যখন ক্যাম্পে বসে থাকি, তখন ভেবে দেখি এটা অন্যায়। কোনোটাই ফেলনা নয়।”’
সৈনিক পল বোমার, হাতে লোডেড রাইফেল আর মনে ওড়ে রঙিন প্রজাপতি।
যুদ্ধরত সৈনিকদের অনুভূতিগুলো সে পড়বার চেষ্টা করে। কেউই মরতে চায় না, সবাই চায় বাঁচতে। কেউ যুদ্ধ চায় না, চায় শান্তি। তবু তাদের যুদ্ধ করতে হয় ‘রাষ্ট্রের’ জন্য, ক্ষমতাসীনদের লাজ-আব্রুহীন নোংরা ইচ্ছেগুলো পূরণের জন্য।
সৈনিকেরা স্বপ্ন দেখে যুদ্ধ শেষে তারা কী করবে, অথচ একদম জানা নেই এখনই একটা গোলা তাদের স্বপ্নগুলো ছাই করে দিবে কিনা।
সৈনিক ডেটারিং যুদ্ধে আসার আগে ছিল চাষী। “তার মাথায় চাষবাস ছাড়া কিছু নেই। যুদ্ধ করবে কী, সারাক্ষণ বউ আর জমির চিন্তা।” আর সৈনিক মুলার তো বইপত্র নিয়েই যুদ্ধে এসেছে। চিন্তা একটাই, ফিরে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হবে।
অবসরে সাধারণ সৈনিকেরা নিজেদের মধ্যে আলাপ করে যুদ্ধ নিয়ে। তারা কেউ বুঝতে পারে না যুদ্ধ করে তাদের কী লাভ হচ্ছে। একজন সৈনিক বলে, ‘আমার তো মনে হয় স্বয়ং জার্মান সম্রাট কাইজারেরও কোনো লাভ হচ্ছে না। তার তো সবই আছে। বাড়ি গাড়ি নারী। যা চায় তা-ই পায়। তাহলে কেন যুদ্ধ করছে?’
অপর সৈনিক বলে, ‘আমার মনে হয় কাইজারের লাভ আছে। কারণ এটা ছাড়া কোনো যুদ্ধই করতে হয়নি তাকে। যুদ্ধ না হলে সম্রাটরা বিখ্যাত হবেন কি করে? ইতিহাস বইয়ে দেখোনি এসব?’
যুদ্ধের ভয়াবহতা মন থেকে তাড়াবার জন্য তারা কৌতুক করে। বীভৎস স্মৃতিগুলো থেকে ভুলে থাকার আর কোনো উপায় নেই।
“সবকিছু নিয়ে হাসিঠাট্টা করি আমরা, কেউ মারা গেলে বলি— ও ইন্তেকাল ফরমাইয়াছে।”
কখনো কখনো বিজ্ঞোচিত কৌতুকও হয়, তাতে লুকানো থাকে শাসকের প্রতি ক্ষোভ, নিজের প্রতি হাহাকার।
“ক্রপ বলল, আসলে এভাবে যুদ্ধ হওয়া উচিত নয়। যে যে দেশ যুদ্ধ করতে চায় তাদের সব মন্ত্রী আর জেনারেলদের ধরে ধরে ঢোকাতে হবে এরিনায়। তারপর প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে লাগিয়ে দিতে হবে যুদ্ধ। ঠিক ষাঁড়ের লড়াইয়ের মতো। লোকজন টিকেট কেটে ঢুকবে ভেতরে। পুরো স্টেডিয়াম রঙবেরঙের কাপড় দিয়ে সাজানো হবে। যুদ্ধে যে দলের সবাই মারা যাবে তাদের দেশ হারবে। ভাবো তো, কত সোজা হয়ে গেল যুদ্ধটা!”
আবার কখনো ক্ষোভে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে—
“যুদ্ধ করে মরি আমরা, আর ফায়দা লোটে যতসব চাটার দল।”
‘ক্যান্টারক’ চরিত্রটির উপস্থিতি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, এই ধরণের শিক্ষক/বুদ্ধিজীবি সব যুগেই থাকে,— যারা পিতৃভূমি রক্ষার নামে, জাতীয়তাবাদী স্লোগানে, বুদ্ধিদীপ্ত চটকদার কথা বলে জনতাকে ক্ষেপিয়ে মাঠে নামায়, কিন্তু তারা থাকে আড়ালে আবডালে। যদি কখনো মাঠে নামে তাহলে দেখা যাবে অকাটমূর্খ ছাত্রের চেয়েও তারা অকর্মণ্য। তারা পারে শুধু গবেষণাগারে বসে বসে থিয়োরি লেখতে আর ভাষণ দিতে, দৌড় এদ্দূরই।
নিরাশা আমাদের মস্তিষ্কে জেঁকে বসে, যখন রেমার্কের মতো আশাবাদীরাও এই সত্য লুকিয়ে সান্ত্বনা দিতে পারেন না— “আসলে বাইরে যাই হোক, মানুষ মনে মনে এখনো পশুই রয়ে গেছে। পশুর সাথে পার্থক্য ওখানেই যে, মানুষ খারাপ ব্যাপারটাকেও বেশ রঙচঙ লাগিয়ে সুন্দর করে হাজির করতে পারে।”
(গ)
প্রশ্ন তৈরি হয়, ‘যুদ্ধের কি তাহলে কোনোই প্রয়োজন নেই?’ এই প্রশ্নের উত্তর তালাশ করতে গিয়ে আরেকটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়— ‘যুদ্ধ তবে হয় কেন?’
ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের কেন অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে হয়,— কেন রাজ্য জয়ের জন্য সাজিয়েগুছিয়ে ছেড়ে দিতে হয় অশ্ব, কেউ বাধ সাধলে তার জন্য সাজতে হয় রণসাজ? কেন ব্রিটেনের মহারাণীর খুবলে খেতে হয় অশ্বেতাঙ্গদের মগজ— কালো থাবায় কলঙ্কিত করতে হয় পূর্ব থেক পশ্চিম, কেন ফ্রেঞ্চদের রনেসাঁস রক্ত শুষে কৃষ্ণকায় আফ্রিকার, কেন হিস্পানিওয়ালাদের গণহত্যা চালাতে হয় আদি আমেরিকোদের, কেন ডাচদের খাজনার ভয়ে ঘুমাতে পারে না নিরীহ জনতা, কেন আমেরিকার বিরুদ্ধবাদীদের সন্ত্রাস আখ্যা দিয়ে আগ্রাসন চালাতে হয় ভিয়েতনামে, কোরিয়া, কিউবায়, আফগানিস্তানে, কেন রাশিয়ার লালে লাল করতে হয় দুনিয়া, কেন চীনের রক্তের তৃষ্ণা মিটে না, কেন সৌদি আরবের মাগীবাজ মদ্যপ শাসকদের পদতলে পিষ্ট হয় ন্যায়পরায়ণতা?
এর কারণ আর কিছু নয়, মানুষেরই অবিচ্ছেদ্য হিংস্র প্রকৃতি, শতসহস্র বছরেও যাতে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ধর্ম আর ন্যায়নীতি মানুষকে মুখোশ পরিয়েছে কেবল, কিন্তু সময়ে সময়ে সেই মুখোশ খসে পড়ে, ‘মনুষ্যত্ব’ কিংবা ‘মানবতা’ নামের আড়ালে নিজের স্বভাব লুকাতে পারে না মানুষ। আর মানুষ তো জানোয়ার বৈ অন্য কিছু নয়, পার্থক্য শুধু বুদ্ধিমত্তায়। কিন্তু মানবেতিহাসে এই বুদ্ধি সার্বিক মঙ্গলের জন্যে নয়, বরং লোলুপতা ও হিংস্রতাকে ভদ্র-খোলসে এঁটে পরষ্পরকে শোষণের জন্যেই ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে বেশি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি— যা নিয়ে মানুষের গর্বের শেষ নাই, এর উৎকর্ষতা নারকীয় হত্যাযজ্ঞে দিয়েছে নতুন মাত্রা স্রেফ। প্রকৃতপক্ষে মনুষ্যত্ব কেবলই একটি শব্দ, পশুত্বই আসল সত্য, আর দুঃখজনকভাবে ইতিহাস আমাদের একথা এড়িয়ে যাবার সুযোগ দেয়নি কখনো।
(ঘ)
জার্মান, অস্ট্রো-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য, রাশিয়ার জার শাসন আর ওসমানি খেলাফতের পতনের মধ্য দিয়েই কি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটেছে? মোটেও না। এই মহাসমর গড়িয়েছে আজকের দিন পর্যন্ত, এবং কেউ জানে না কবে ঘটবে তার অবসান।
সর্বশেষ পৃথিবীবাসী যেই যুদ্ধটি দেখেছে,— ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিপরীতে ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রাম, ২৪৮ জন নিরপরাধ নাগরিকের মৃত্যু, সেখানেও ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব। নেতানিয়াহু এই নৃশংসতার সমর্থন করায় যেই পঁচিশটি রাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানিয়েছে, তার মধ্যে জার্মানও ছিল। দুই দুইটা বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়ে, কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু আর লাখ লাখ পরিবারকে নিঃস্ব করার দায়ভার নিয়েও জার্মান এখনো তফাৎ বুঝেনি জালেম আর মজলুমের। নাকি বুঝেও সেই পুরানো রক্তপিপাসা জিইয়ে রাখতে স্পষ্ট জালেমকে জুগিয়ে যাচ্ছে সমর্থন? তা-ই নয় কী?
একটু পেছনের ইতিহাসে ফিরি। জায়নবাদের মতো একটি ঘৃণ্য মতবাদের জন্ম পৃথিবীতে আচমকা হয়ে গেছে, ব্যাপারটা এমন নয়। এভরিথিং ইজ কানেক্টেড। ইউরোপে ইহুদিদের ভাগ্যে যা ঘটেছে, হত্যা আর নির্বাসন, অর্থনীতিতে অগ্রসর ইহুদি জাতির আলাদা রাষ্ট্রের ধারণা তার ফলেই হয়েছে। টিওডার হার্ৎজেলের মস্তিষ্কে ‘ইহুদিদের আলাদা ভূমির ধারণা’ এমনি এমনি আসেনি। অস্ত্রের বিনিময়ে ব্রিটিশদের কাছে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের দাবি কিংবা জারের বিরুদ্ধে লেনিনকে রেভুলোশনে মদদ ইহুদিরা সেই ক্ষোভ থেকেই করেছে। ‘দেয়ালে পিঠ ঠেকলে বিড়ালও কুকুরের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে’— ইউরোপে ইহুদিদের অবস্থা তা-ই হয়েছিল। কিন্তু ফিলিস্তিনের কেন এই ভাগ্য বরণ করতে হলো? এর দায় অবশ্যই কেবল ইহুদিদের নয়। হাতে রক্ত লেগে আছে অনেকেরই। ওসমানি খলিফার অপশাসন ও সিদ্ধান্তের ভুল, শরিফ হুসাইন বিন আলির ক্ষমতার লোভ আর সৌদ বংশের স্বজাতির সাথে গাদ্দারির ফলেই ফিলিস্তিনে প্রতিষ্ঠা পায় ব্রিটিশদের ম্যান্ডেট শাসন, ইতিহাস তা ভুলে যায়নি।
১৯১৪ সালের অক্টোবরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানীয়রা যোগদান করে অক্ষশক্তিতে। এরপর পরাজিত হয়ে তুর্কিবাহিনী একে একে ভূমি হারাতে থাকে। ১৯১৫ সালের এপ্রিলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স সম্মিলিত সামরিক বাহিনী নিয়ে সরাসরি আক্রমণ করে ইস্তাম্বুলে। আট মাসের এই যুদ্ধে শেষতক তুর্কিবাহিনীর জয় হলেও ব্রিটেন দখল করে নেয় ইরাক ও বাগদাদ। ১৮৮৮ সালেই ব্রিটেন মিশর দখল করে নিয়েছিল। এবার ব্রিটিশ সরকার পরিকল্পনা করে পবিত্র ভূমি জেরুসালেম দখলের। জেনারেল এলেনবির নেতৃত্বে কুখ্যাত ব্রিটিশ গোয়েন্দা টি. ই. লরেন্স আরবদের প্রাচীন মূর্খতাকে পুনরুজ্জীবিত করতে সক্ষম হয়, চিরায়ত নিয়ম ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ প্রয়োগ করে ১৯১৭ সালের ৯ ডিসেম্বর জেরুসালেম দখল করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে ক্রিসমাসের উপহার হিশেবে প্রদান করে।
১৯১৭ সালের দোসরা নভেম্বর জায়নবাদী নেতা ব্যারন রথসচাইল্ড তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব আর্থার ব্যালফোরকে একটি চিঠিতে জানান ফিলিস্তিনে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ব্রিটেনের সমর্থন রয়েছে। কারণ, প্রথমত ইহুদিরা ছিল অর্থনীতিতে শক্তিশালী, তাদের সমর্থন প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত হাইয়িম আজরাইল ভাইৎজমানের অস্ত্রের কারখানা ছিল, যেখানে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি হতো, তা বিনিপয়সায় পাওয়ার আশায়। তৃতীয়ত উগ্র ডানপন্থী খ্রিষ্টানেরা মনে করে ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র কায়েম হলে ইসা-মসিহর পুনরুত্থান হবে। তাই যুদ্ধশেষে ওয়াদামাফিক জায়নবাদীদের ফিলিস্তিন ভূখণ্ড দেওয়া হলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদিরা আসতে থাকে দলে দলে। ব্রিটিশ ম্যান্ডেট সরকার এক্ষেত্রে কিছু নিয়ম বেঁধে দিলেও তার দুই পয়সা মূল্য ইহুদিরা দেয়নি। ওদিক দিয়ে আরবদের সাথেও বাঁধতে থাকে সংঘাত। কিন্তু ইহুদিরা আসতেই থাকে। আরবদের ভূমি দখল করে, লাখ লাখ মানুষের জীবন-জনম নরক বানিয়ে, গড়তে থাকে মাটির দুনিয়ায় তাদের কাল্পনিক স্বর্গরাজ্য।
কোনো কথাবার্তা ছাড়াই একটা দেশে উড়ে এসে জুড়ে বসা যায় না। তাছাড়া ফিলিস্তিনে ছিল ব্রিটিশদের ম্যান্ডেট শাসন, উপনিবেশ নয়, তাই তারা চাইলেই এই ভূখণ্ড অন্য কাউকে দিয়ে দিতে পারে না। বড় ধরনের আপত্তি থাকে। কিন্তু ঠিক সেই সময় জায়নবাদীদের দখলবাজিকে জায়েজিকরণের জন্য ধরাধামে অবতরণ করেন হলোকাস্টের নবি অ্যাডলফ হিটলার। হিটলারের এই নীতিহীন ইহুদিনিধনই পরবর্তী কয়েকশ বছর জায়নবাদীদের মায়াকান্নার ফুরসত আর ‘অ্যান্টি-সেমিটিজম’ টার্ম বানানোর যৌক্তিকতা তৈরি করে। যেই টার্ম ব্যবহার করে উপন্যাস-সিনেমা আর মিডিয়ার সহায়তায় তারা মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছে তারা পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় অভাগা জাতি। ফলে ১৪ লাখ বাস্তুহারা ইহুদিদের স্থান দিয়ে, অতঃপর ১৯৪৮ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে জয়লাভ করে পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় আরো একটি বিষফোঁড়া— এরৎজে ইসরায়েল।
গত সত্তর বছরে অনেক এমন কিছুই ঘটেছে যা ঘটবার মতো ছিল না। আরবদের বিচ্ছিন্নতা আজও ঘুচেনি, ফিলিস্তিনিদের মধ্যেও হয়নি একাত্মতা। ফিলিস্তিনকে গ্রাস করতে করতে পুরোটাই গ্রাস করে ফেলে এতদিনে, বাকি থাকে কেবল ওয়েস্ট ব্যাংক। সম্প্রতি পবিত্র রমজানের শেষদিকে সেই অংশটুকু গিলে খেতে শেখ জাররাহয় ফিলিস্তিনিদের ওপর চালায় সহিংস আক্রমণ। হঠাৎ প্রতিআক্রমণ করে বসে ফিলিস্তিনের হামাস। যা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। মিডিয়া এই প্রতিআক্রমণকে ডিসক্রাইব করে ‘সন্ত্রাসী হামলা’। কিন্তু জুলুমের শক্তিশালী আয়রন ডোম এবার আর আলোর ঝলকানিকে রুখতে পারেনি। এগার দিনের যুদ্ধে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি বহন করে অবশেষে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়। ফিলিস্তিনিদের মুখে হাসি ফোটে, যদিও এটাকে জয় বলা যায় না।
(ঙ)
যুদ্ধবিরতির একদিনের মাথায় আবার ফিলিস্তিনে সৈন্য পাঠিয়েছে ইসরায়েল। কী ঘটতে যাচ্ছে তা আর অবোধগম্য নয়। আবার আগ্রাসন। আবার বেসামরিক নাগরিক ও শিশু হত্যা। আবার পৃথিবীতে না-ইনসাফির প্রতিষ্ঠা এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রপ্রধানদের তাতে নগ্ন সমর্থন। আবার মিডিয়ায় ওয়েস্ট ব্যাংকের স্বাধীনতাকামীদের সন্ত্রাসী উল্লেখ ও সত্যপ্রকাশকদের চাপ প্রয়োগ। আবার বুদ্ধিবৃত্তিক ইনকিলাবের পরিবর্তে মুসলমানদের হাত গুটিয়ে বসে থেকে একজন ইসা-মসিহের অপেক্ষমাণতার বয়ান। আবার আবার আবার। আমরা যুদ্ধ আর যুদ্ধবিরতিতে আটকে আছি। আমরা হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করতে পারছি না আবার পারছি না যুদ্ধকে এড়াতে। আমরা এক জিনিসই বারবার বারবার দেখে যাচ্ছি করে যাচ্ছি— কোনো পরিবর্তন নাই এতে, কোনো আশাবাদ নাই এখানে, কোনো সুখময় ভবিষ্যৎ নাই, কিছুই নাই— নাথিং নিউ ইন দ্য ওয়েস্ট।
Leave a Reply