সংবিধান ও রাষ্ট্রধর্ম দুটোই কোন ইসলামী কনসেপ্টে নয়। মদীনা সনদে কোন রাষ্ট্রধর্মের কনসেপ্ট ছিল না। আপনারা এমন কিছু কি ইসলামে ঢুকাতে চান যা আদি ইসলামে ছিল না? সংবিধান ও রাষ্ট্রধর্ম দুটোই পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজাদের চিন্তার ফসল। ইসলামের সাথে এসবের জন্মগত কোন সম্পর্ক নাই। রোমান সম্রাট 313 খ্রীস্টাব্দে সর্বপ্রথম রোমের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন। সেই থেকে রাষ্ট্রধর্ম কনসেপ্টের শুরু।
বাংলাদেশের সংবিধান আগাগোড়াই গোঁজামিলের সংবিধান । সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে একই পংক্তিতে গণতন্ত্র সমাজতন্ত্রকে রাখা হয়েছে। গণতন্ত্রের সাথে কি সমাজতন্ত্র যায় অথবা সমাজতন্ত্রের সঙ্গে গণতন্ত্র ? বাংলাদেশ কি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র? বাংলাদেশের বিদ্যমান মুক্তবাজার অর্থনীতি কি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সঙ্গে যায়? আবার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম কিন্তু মূলনীতিতে বলা হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হবে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে । এমন আলংকারিক রাষ্ট্রধর্ম আর সমাজতন্ত্র জাতির কি প্রয়োজন পূরণ করবে?
রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের প্রয়োগিক কোন ব্যবহার নেই। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে যুক্ত করার ফলে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কোনো পরিবর্তন আসেনি।
খুশবন্ত সিং এরশাদের শাসনামলে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়ার পরে এদেশে এসেছিলেন। বাংলাদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি একটি প্রবন্ধও লেখেন। তিনি বেশ অবাক হয়েছিলেন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়ার পরেও এদেশে এত অনৈসলামিক কাজ চলে কি করে?
দেশের সমস্ত আইন-কানুন যখন ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। তখন আলংকারিক ভাবে রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানে থাকা না থাকা নিয়ে রাষ্ট্রধর্মের সমর্থকরা এত চাপ নিচ্ছে কেন?
এরশাদ যখন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেন জামাত ইসলাম তখন রাষ্ট্রধর্মের বিরোধিতা করেছিল। সেই জামাত ইসলাম এখন কিসের উপরে ভিত্তি করে রাষ্ট্রধর্মের পক্ষে সওয়াল করছে? এটার ব্যাখ্যা জামাত কখনো দেয়নি।
অমুসলিম দেশে মুসলিম সংখ্যালঘুদের স্বার্থ বিঘ্নিত না হোক সেটা যদি চান তাহলে আপনিও এমন কোনো আইন সমর্থন করতে পারেন না যা সংখ্যালঘুদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। আমরা নিজেদের জন্য যা চাই ভিন্ন দেশের ক্ষেত্রেও কি তা চাই ? বাংলাদেশ কে অনুসরণ করে যদি সব হিন্দু ও খ্রিস্টানদেশ তাদের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিন্দু বা রাষ্ট্রধর্ম খ্রিস্টান ঢুকিয়ে দেয় তাহলে কি তা সভ্য সমাজের জন্য ভালো কিছু হবে? বিশ্বের সব দেশের সংখ্যালঘুরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হোক এটা কোন সুস্থ মানুষের কাম্য হতে পারে? এইতো কিছুদিন আগেও নেপাল সাংবিধানিকভাবে একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র ছিল । সেখানে গো হত্যাও আইনগতভাবে নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে নেপালে সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু করে। নেপাল পেরেছে বাংলাদেশ হেরে গেছে, হেরে গেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে আমরা আমাদের সমাজ সম্পর্কে ভুল মেসেজ দিয়েছি । ফলে এদেশের মানুষ কে সন্তুষ্ট করার জন্য প্রিয়াঙ্কা চোপড়া মুসলিম নারীদের মত স্কার্ফ পরে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন ………। রাষ্ট্রধর্ম বহাল থাকলে কি কি ক্ষতি হবে তা বোঝা যাবে ধীরে ধীরে। ভারতের এনআরসি ক্যাব এর পিছনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের অবদান কম নয় । কাজেই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনই। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র কে চ্যালেঞ্জ করেই বাংলাদেশের জন্ম। ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতার কারণেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম থাকতে পারেনা ।
জহুরুল হক
চিন্তক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
Leave a Reply