মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে বরিশালে যাচ্ছিলাম। পদ্মানদী পার হতে লঞ্চে উঠেছি। ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি পরিস্থিতি ছিলো সন্তোষজনক। লঞ্চে উঠেই মানুষের ভিতরে স্বাস্থ্যবিধির আর কোন বালাই নাই। না মানছে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ, না মানছেন যাত্রীরা। যে যেরকম পারছে অবহেলা করছে। পাশে যে ভদ্রলোক বসেছিলেন তাকে অনুরোধ করলাম অন্তত মাস্কটা ব্যবহার করুক। আচমকা উল্টো ক্ষেপে গিয়ে বললেন- কেউ মানছে না, তাকে কেন মানতে হবে!
বর্তমানে কোরবানি পরবর্তী জুলাই মাসের দ্বিতীয় দফা লকডাউন চলছে। সিদ্ধান্ত হয়েছিল গার্মেন্টস শিল্প বন্ধ থাকার। কর্ম প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ, শহরে বাড়তি খরচের চাপ এবং কোরবানির আগে এক সপ্তাহের মতো লকডাউন শিথিল থাকায় গ্রামে ফিরেছিলেন অনেকে। কিন্তু যানবাহন স্বাভাবিক না হয়ে, হঠাৎ করে লকডাউন চলা অবস্থাতেই গার্মেন্টস শিল্প খোলার সিদ্ধান্তে বিপাকে পরেছে অর্থনীতির কারিগর গার্মেন্টস শ্রমিকেরা। লেজেগোবরে এক করে যখন পরিবহন ব্যবস্থায় শিথিলতা আসলো ততক্ষণে ভোগান্তি নিয়ে যাত্রীরা পৌঁছে যাওয়ায় প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
পহেলা জুলাই থেকে শাটডাউন বাস্তবায়নের চেষ্টা হয়েছে। তারও আগে সীমিত পরিসরে লকডাউন ছিল তিনদিন। লকডাউন হোক বা শাটডাউন হোক এই তথ্য আগাম প্রচার করে মারাত্মক ভুল করেছে সরকার। ঘোষণা আসার পর পরেই ঘরে ফেরা মানুষকে আর ফেরানো যায়নি। তাদের গন্তব্যস্থল ছিল গ্রামের বাড়ি। হঠাৎ করে আবার ফিরতি ঢলে স্বাস্থ্যবিধি কড়াকড়ি করার সুযোগ নেই। অর্থাৎ গ্রামে ফেরা মানুষের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস নিজেদের বিস্তারের সুযোগ পেল। একেই ঘটনা ঘটেছে গত ঈদ-উল-ফিতরের সময়েও।
সংক্রমণ যখন তুঙ্গে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বারবার করুন পরিণতির হুশিয়ার আসছে, প্রতি ঘরে ঘরে মানুষ যখন জ্বরে কাঁপছে তখন কোরবানির ঈদ সামনে রেখে লকডাউন একসপ্তাহ শিথিল করার প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছিল। হতবাক হয়েছিল খোদ লকডাউন পরামর্শক কমিটিও। মানুষজন স্থানান্তরের এই সুযোগে নতুন করে তৈরি হচ্ছে মহা-আশঙ্কা। পূর্বে ঢল নেমেছিল বাস এবং লঞ্চ টার্মিনালে, উপেক্ষিত হয়েছিল স্বাস্থ্যবিধি। এখন যার খেসারত দিতে হচ্ছে গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোকে।
রাজশাহী, খুলনা এবং সিলেট বিভাগের জেলাগুলোসহ সারাদেশে ভারতীয় ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। ঢাকাসহ অর্ধশতাধিক জেলায় বেড়েছে করোনার উচ্চ সংক্রমণ। বেড়েছে মৃত্যুর হার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এটা স্পষ্ট। বাধ্য হয়েই একরকম লকডাউন বা শাটডাউনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কোরবানিতে একমাত্র ঢাকা ত্যাগ করেছে ১ কোটি ৫ লক্ষ মোবাইল কোম্পানির সিম ব্যবহারকারী। কোরবানির ঈদ সামনে রেখে শিথিলতার ঘোষণা এবং কোরবানির হাটের স্বাস্থ্যবিধি উদাসীনতার কারণে মারাত্মক বেসামাল পরিস্থিতির অপেক্ষায়, এর ভিতরে এমন অপরিপক্ক সিদ্ধান্ত মরার উপর খাঁড়ার ঘা। এর ফলাফল যে কতটা দুর্ভাগ্যজনক হলো, তার প্রমাণ আমরা হাতেনাতে পাচ্ছি এবং কয়েকদিন পর হয়তো আরো ভয়াবহভাবে পাবো।
এখন প্রশ্ন দাঁড়ালো গার্মেন্টস কর্মজীবীর বাইরে নাগরিকেরা সরকারের পরামর্শ বা সিদ্ধান্ত মানছেন না কেন? লকডাউনের ভিতরেও তারা কেন ছোটাছুটি করছেন? মেডিকেলের খালি ফাইল হাতে নিয়ে অযথা ঘোরাফেরার ঘটনা কেন ঘটেছে! মানুষ কি ছুটি পেয়ে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে গ্রামে ফিরেছিলেন? অথবা লঞ্চের ভদ্রলোক কেন স্বাস্থ্যবিধি মানতে চাইলেন না? সত্যি বলতে সাধারণ মানুষের ভিতরে সচেতনতা নেই এমনটা না, বরঞ্চ দীর্ঘদিনের লকডাউনে নাগরিকেরা অনিশ্চয়তায় পরেছেন। এই অনিশ্চয়তাটা হল খাবারের এবং অর্থনৈতিক। আক্রান্ত হলেও চিকিৎসা তাদের জুটছে না এটা ভালো করেই তারা বুঝতে পারছেন।
সর্বাত্মক লকডাউন চলাকালীন কেউ বিনাকারণে ঘর থেকে বের হলে গ্রেফতার করছে পুলিশ। যেতে হচ্ছে জেল-হাজতেও। গত বছর লকডাউন কার্যকর করতে মুরুব্বিদের প্রকাশ্যে কান ধরিয়ে ছবি তুলে অনলাইনে ছেড়েছিলেন দায়িত্ব প্রাপ্তরা। পিটিয়েছেন, শাস্তি দিয়েছেন যাতে লোকজন বাইরে না যায়। পুলিশ কতৃক চায়ের কেটলি জব্দ করার ছবিও অনলাইনে ঘুরেছে। কিন্তু একবারের জন্যও কি আমাদের নীতিনির্ধারকেরা ভেবেছেন, কাজ করতে না পারলে দিন এনে দিন খাওয়া এ-সব গরিব শ্রমজীবী মানুষগুলো খাবে কি! চাকরি বাঁচাতে শেষ চেষ্টা তারা করবেন না? গৃহহীন মানুষেরা যাবে কোথায়?
দেড় বছরে করোনাভাইরাস মহামারী ও টানা লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নিম্নবিত্তশ্রেণীর মানুষেরা। ক্ষতিগ্রস্ত, কর্মহীন, বেকার ও ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকদের পাশে সরকার ও মালিকপক্ষ দাঁড়ায়নি; দেয়নি কোন প্রণোদনা। গার্মেন্টস বন্ধ করে বেতন দেয়ার নামে শ্রমিকদের পায়ে হেটে ঢাকায় আনার ঘটনাও ঘটেছে গতবছর। শাটডাউনেও কারখানা খোলা রেখে ঘটেছে আগুনে পুড়িয়ে কাঠামোগত শ্রমিক হত্যার ঘটনা। নতুন করে ২.৫ কোটি মানুষসহ দারিদ্রসীমার নিচে নেমে গেছে অর্ধেকেরও বেশি সংখ্যক জনগণ। কারখানা খোলা রেখে অথবা খাবার না পৌছিয়ে গ্রেফতারের ভয় দেখালে, এ-সব মানুষ কারখানায় যাবে কি করে?
লকডাউন, শিথিলতা এবং লকডাউনের আগাম তথ্য দিয়েই সরকারপক্ষ তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। গেল বছর যতটুকু সাহায্য সহযোগিতা হয়েছে গরিব মানুষের দুয়ারে সিকিভাগও পৌঁছায়নি। বরং আমরা দেখলাম প্রভাবশালী নেতারা সেগুলো ভাগবাটোয়ারা করেছেন, খাটের নিচে বোঝাই করে রাখা তেলের মজুদও সবাই দেখেছি। লাভ হয়েছে নেতাদের, চেয়ারম্যান-মেম্বারদের এবং আমলাদের, যাদের জন্য সাহায্য তাদের ঘরে যায়নি। করোনা প্রতিরোধে সর্বদলীয় প্লাটফর্ম গঠনের আহ্বান করলে, একমাত্র সরকারি দলেরই তাতে সারা ছিলো না। তাহলে কি তাদের উদ্দেশ্য ছিলো চোরের ঘরে গরিবের বরাদ্দ পৌঁছানো? নাকি নীতিনির্ধারণী সঠিক ছিল না? অথচ সঠিকভাবে বরাদ্দ পৌছাতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যেখানে সচেষ্ট ছিলেন।
করোনায় ভাইরাস প্রতিরোধে দীর্ঘ সময় পেয়েও আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। সঠিক ব্যবস্থায় ৫০ ভাগ মানুষকে না দেয়া গেছে ভ্যাকসিন, না করা গেছে অক্সিজেন প্লান্ট। উপরন্তু চট্টগ্রামের সিআরবিতে গাছ কেটে সরকারি-বেসরকারি পার্টনারশিপের মাধ্যমে হাসপাতাল তৈরি করার হুজুগ। করোনা প্রতিরোধের নানান সরঞ্জাম নষ্ট হয়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়। চিকিৎসা খাতের লুটপাট দুর্নীতির দৃষ্টিগোচর হয়েছে। সংবাদকর্মীরা হেনস্তার স্বীকার হয়েছেন মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণের সামনে তুলে ধরায়।
সর্বশেষ সপ্তাহ গুলোতে মৃত্যু বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণ। দৈনিক গড়ে প্রায় ২০০ জনের জনের কাছাকাছি মানুষ মারা যাচ্ছে। এমনকি এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে দৈনিক মৃত্যু হারের তালিকায় বিশ্বে শীর্ষ দশে অবস্থান করেছিল বাংলাদেশ। কোরবানি পরবর্তী ২৩ জুলাই থেকে দ্বিতীয় দফা লকডাউনে গার্মেন্টস-কারখানা বন্ধ ছিল, এটা ইতিবাচক ব্যাপার। কিন্তু খোলা ছিল চামড়া শিল্পের কারখানা। ১লা আগষ্ট থেকে হঠাৎ করে গার্মেন্টস খোলার সিদ্ধান্তে পূনরায় রাস্তায়, ফেরিতে মানুষের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। ক্ষোভ জানিয়েছে যানবাহন না থাকায়। সমালোচনার মুখে বাধ্য হয়ে একদিনের শিথিলতা আসলেও অব্যবস্থাপনায় ভরপুর। শ্রমিকদের জীবনের কি ঝুঁকি নাই! তারা কি আধুনিক দাসপ্রথার শিকার? পোষাক শিল্প রক্ষা যেমন জরুরি, চামড়া শিল্প রক্ষা যেমন জরুরি; ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ একজন শ্রমিকের জীবন। অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তে শ্রমিক বা তার পরিবার যদি আক্রান্ত হয়, মৃত্যু ঘটে; তার দায়-দায়িত্ব কি মালিকপক্ষ নিতে বদ্ধপরিকর? সত্যি বলতে ঈদ উৎযাপন উপলক্ষে করুণ সময়টা সামনে রেখে গণপরিবহন, শপিং মলসহ দোকানপাট খুলে দেয়া আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া কিছু নয়।
বাসে অতিরিক্ত ভাড়া গুনেও প্রশাসনের মনিটরিং এর অভাবে ওভারলোড যাত্রী ছিল সবসময়। কখনো সীমিত পরিসরে, কখনো শিথিলতা, কখনো কঠোর লকডাউনের নামে, আবার কখনো লকডাউনের ভিতরেই যানবাহনের ব্যবস্থা না করে হঠাৎ করে শিল্প প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ায় অযৌক্তিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য নাগরিকেরা স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদাসীন হয়েছে। জনগণের জীবনের নিরাপত্তার দায় এবং ঘরে ঘরে খাদ্য পৌঁছানো অস্বীকার করতেই লকডাউন-শাটডাউনের খবর আমাদের দায়িত্বশীলেরা আগাম প্রচার করেছেন। ভাইরাস ছড়ানোর সুযোগ দিয়ে বারবার সাধারণ মানুষের উপর দায় চাপলেন।
মানুষকে খাদ্য এবং অর্থ সহায়তা পৌঁছে না দিয়ে লকডাউন বা শাটডাউন বাস্তবায়ন অসম্ভব। অতঃপর লকডাউনের কড়াকড়ি জোরদার করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকায় ক্রমেই অরক্ষিত হয়ে পরেছে আমাদের ভবিষ্যৎ। করোনা প্রতিরোধে নীতিনির্ধারক, আমলা-কর্মচারী সহ সকল পেশাদারিত্ব পর্যায়ের দায়িত্বশীল আচরণও আবশ্যক।
রাজনৈতিক কর্মী ও বিশ্লেষক।
Leave a Reply