ইগারো ’শ সাতাইশ ডি লাশ! ইগারো ’শ সাতাইশ? দুইডি একডি ল্যা রে বুইন? খুঁইজি দেকলি আরো পাওয়া যাতি পারে, বুইজলু? ভবনধসির পর কুড়ি দিন চইলে গেল বিজিমে কুনু কুতাই কইচ্চে না, ইডি কিছু হইলো? সম্বাদিক, উইদ্ধির কর্মী, মানবাধিকির আপারাও কিছুই কতি পারতিছে না। কয়জন লিবার কাজেত আছিল তার হিসিবও দিচ্চে না।
‘আমগিরে জোর কইরি ফান্দের মইদ্দি ঢুকাই দিছিল। কারু হাত-পা গিছে, কেউ তো পাগল হয়্যাই গিছে। আর ওরা আমাগিরে যেইটে দিতি চায় সেইটে তো কিছুই ল্যা। সেই যে মরনু। মাথাত আর পায়েত আঘাত লিয়্যা। সেই যে কাইত হনু, না খায়্যা না দায়্যা। প্যাটের জ্বালাত চোকেও আর দেকতি পারতিছিনি। কানেও শুনতিছিনি। বিজিমি কুনু ঘুষুনাই দিবি ল্যা তালি? সম্বাদিক আসিছিলো, কয়, রানা পিলাজার পাঁচডি কারখানার শ্রমিকগির তালিকা আকুনো প্রকাশ করতি পারবিনি।’ শ্রমিকগিরি ক্ষতিপুরুন দিতি ঘুষুনা করবি ল্যা কী জইন্যি? আমরা কম কইরি হলিও তিন মাসির বিতুন আর উভারটাইম চাইছিনু, ব্যবসায়ী মালিক সমিতি খালি এক মাসির মূল বিতুন দিয়ি বিদিই করতি চায়। ইডি একডি কুতা হইলো? শ্রুম আইনিত্ কী লিকা আছে, আমরা উসব কী কইরি জাইনবো? মালিক সমিতি নাকি কইছিল, তিরিশ দিনির পারিতোষিক, চারকিকালীন প্রতিবছরের জইন্যি এক মাস কইরি মূল বিতুন, এক মাসের গ্র্যাচুইটি আর পাওনা ছুটির টিকার কুতা। আর আকুন লাড়েলাপ্পা।
কিন্তু যিসব শ্রমিক এক বছরের চাইতি কম সুময় কাজ করিছে তাদের শুধু চলতি এপ্রিল মাসের বিতুন দিতি চায়। তারপর আবার এক মাসের বিতুন আর ষাইট ঘুণ্টা উভারটাইম দিতি চায়, তাও মানি লিব কী জইন্যি? সর্বসাকুল্যি আট হাজার টিকা পাইছে আমার পরিবার। আমার গিরাম থিকি বাড়ির লোকজন যে আমারে সাভারে খুঁজতি আইছিলো তাতিই অনেক খরচ হইছিল। বাড়িত থাইকি বাপ, মা, চাতো ভাই, বুইন আইসি দুইদিন মিটফোর্ড, ঢাকা মেডিকেল, সোহরোওয়ার্দী, সিআরপি, ইনাম হাসপাতাল আরও কত কী ঘুইরি ঘুইরি আমাক খুঁইজি পায় নাই। আমি একশ বিশ ঘুণ্টা উভারটাইম করছিনু, আকুন উরা আমাক দিতি চায় ষাইট ঘুণ্টার টিকা, ইডিও কি মানি লিব্যার মুতুন কুতা? এইডি কী রকম বিচির? এপ্রিল মাসের হত্যা। মিসটেক! দুইরঘটনার পরে মে মাসে জীবন হাতে লিয়ি, মইরি বাঁইচি সাভার থাইকি তিন কিলোমিটার দূরির অধরচন্দ্র ইস্কুলিত বিতুনির আশাত বসি থাইকি ইরকম উল্টি কুতা শুনলি শ্রমিকের মিজাজটা কী রকম থাকপিনি রে বুইন? আমি না হয় মইরি গেছি; না হয় বাঁইচি আছি। যারা বাঁইচিও মরার মুতুন, জীবনেত আর খাড়া হতি পারবি ল্যা, তাগিরে কী হবিনি আকুন? আমাক খুঁজা-খুঁজিতি সব টিকা খরচ হই গিছে। আমার না হয় লাশ নাই। কত পরিবার তো পথেই বসিছে, টিকার অভাবে লাশ নিতিই পারতিছে না। যারা মরার মুতুন বাঁইচি আছে, তারাই ঠিকমুতুন বিতুনির আশা করতিছিনি, যারা মইরি গিছি তাগির তো কোনো হিসিবই নাই। বিজিমি কইলো শ্রমিক ৩১২২ জন, আবার কিছু পরেই কয় হিসিব ভুল হইছে। সংখ্যা কমাইনির জইন্যি ভইড্ডমি শুরু করতিছে? উদ্ধির কর্মীরা জানের ঝুঁকি লিয়ি কাজ করতিছিল, বিজিমি কুনু তালিকি পুন্তু দেয় নাই। চালাকির কত রকম, সিয়ানাগিরি, ওরে! বাটপার। প্রতিদিন খণ্ড-বিখণ্ড লাশ, চিপট্যা লাশ, থিতল্যা লাশ, রক্ত-পুঁজ আর মগজ বার হতিছে। চিনপরিচয়হীন লাশ-গুলির কী গতি হবিনি? মালিক সমিতি ইকাক বার ইকাক সংখ্যা বলতিছে। সংখ্যা কুমানোর ধান্দায় শ্রমিকের বিতন তালিকিও দিতি গরিমসি করতিছে।
ইগল্যা কী জইন্যি ঘটে? জীবনের কুনু মূল্যি নাই, আমাগিরি? বিরাকের অফিস আছিল, রানা পিলাজাার দুই তালাত। ঝুঁকির ভয়েত তারা অফিস বন্দ কইরি দিল, আর আমাগিরে ভয়-ভীতি দিকায়ে বাধ্য কইরি কাজ করাতিছিল। ক্যান, আমাগিরি গার্মেন্ট বন্দ কইরি দিলি এই হাজার হাজার শ্রমিক মইরতো? অর্তমুনতিরি আর গার্মেন্ট মালিকেরা শ্রমিকের জীবনের চাইতি, জিএসপি বাতিল ভয় আর বিদ্যাশি খরিদ্দারের অর্ডার বাতিলের ভয়ের চিন্তায় দিশ্যা পায় না। শ্রমিকের জীবনের চার আনা মূল্যও তাগোর কাছে নাই। গণমাইধ্যম, না কি পত্রিকি, রেডিও টেলিভিশনগুলিও; দায়িত্ব লিয়ে মালিক সমিতির চাঁওয়াই গায়। শ্রমিকের দাবি-দাওয়া, অসন্তোষ্টু, বাকি বেতনের জইন্যি ধর্মঘট ইসব তাগির কাছে বাজে লোকদিগির কাজ ও ষড়যন্ত্র নামেই পরিচিত। সগল দাবির ঘটনাতই সরকারের সুর মালিকগিরে পক্ষেত যায়। মাসের পর মাস বেতন পইরি থাকলি, ঈদ বোনাস না দিলি, ওভারটাইম না দিলি সরকারের গাল টিপলিও মালিকগিরি বিরুদ্ধে কুতা কবিনে। বকেয়া পাওনার দাবি করলি, আন্দোলন করলি পুলিশ আর মাস্তান দিয়ি পিটাই মুখ বন্ধ কইরেই থামে। মামলা ও করে। মালিকপক্ষ দ্যাশেত রাজা-জমিদার; হেলিকপ্টার, চার্টার বিমান লিয়ি দ্যাশ-বিদ্যাশ ঘুইরি বিড়ায়। পরিবার লিয়ি বিদিশ সফর যায়। বিদিশেত বিবস্যা করে, কোম্পানী কিনে, হোটেল কিনে, মেয়েমানুষ কিনে, রাজপ্রাসাদ কিনে। দ্যাশেত ব্যাংক লুটপাট কইরে খায়্যা তারা বিদ্যাশেত যায়া হাওয়া ত্যাগ করে, হাগে। বিশ্বের বাজারে তারা মেনি বেড়ালের মুতোন। সামান্য দরকষাকষির মুরোদটুকুও তাগোর নাই।
আমাগের দ্যাশ কি বিদ্যাশি বাজারের দয়াত বিবস্যা-বাণিজ্যি করে? শস্তা শ্রমিক খাটায় আর চোঙ্গাভর্তি লাভ লিয়্যা বিশ্ববাজার এখানে বিবস্যা করে। শস্তাশ্রমিক মালিকগিরে কোম্পানীর পিলার, এ কুথা তারা মুনিত জানলিও বিবেকে পোষণ করে না। ভবনধস, আগুন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ইসব লিয়্যা তাগোর কোনো মাতাব্যতা নাই। তারা চায় কেবল মুনাফা।
২৪ এপ্রিল ২০১৩। একুনো পষ্ট মুনে আছে। কাজ শুরুর আগের মুহূর্তে মাইকে ম্যানেজারের ঘোষণা, ‘কারো ভয় নেই, বিদেশী ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে সব ঠিক করে দেওয়া হবে। সবাই যার যার কাজ করো।’ মনে রাগ আর ভয় ভয় ভাব লিয়ে শিফটে যোগদান করনু। হঠাৎ পায়ের তলা থাইকে ফ্লোরটা সইরে গেল যেন। বিকট আওয়াজে মনে হলো কানের তালা ফাইটে গেল। এক মুহূর্তে মনে হলো, একবার, যদি একবার বাইঁচে থাকি। ফির্যাক যাবো পরঙ্গী ধানের দ্যাশে। হাঁস পালন কইরবো আর সাঁতরে এপার থেকে ওপারে যাবো চিরচেনা গাঙের। আমন ধানের শুকনো মুথা দাঁতে চাইপে এক ডুবে এপার গাঙের ওপার যাবো। সইন্ধ্যা থেকে দুই পা আর চালুনি রাঙাবো বড়ি আলতা দিয়ে। আল্পনা আঁকবো চালবাটা দিয়ে। কোড়ানো নারকেল আর তালের আঁটির ফোঁপড়া দিয়ে আউশের ধানের ঢেঁকিছাটা চালের মুড়ি, মচমচ করে খাবো। গাস্বির রাতে ভূত সাজবো, হাতে তুইলে লিবো কালো পাতিল, দুই হাত উঁচু কইরে মাথার ওপরে তুইলে রাইখবো পাতিল। দাদীর সাদা কাপড়ে জড়িয়ে রাইখবো পুরো শরীরে। মুখটা ঢাইকে রাইখবো আর পাড়াময় ঘুইরে বেড়াবো। দাদীর সাদা কাপড়খানা কিছুতেই শরীর থেকে আলাদা করা যাচ্ছে না। আমার কেন যেন ঘুম পাচ্ছে। যদি একটি সুযোগ পাই ফির্যাে যাবো বাঁকা তালগাছ আর নদীটির কাছে। উত্তরের মাঠে দুধসাগর আর আজলদিঘা ধানের চকচকে সবুজ পাতাগুলান যদি আর একটিবার বুকে জড়ায়্যা ধইরতাম। গোঙড়া গাড়ির মাঠের উঁচু জমির ধারে যে আউশ ধানের নাচন তা আর কোনো দিন দেখতে পারবো নে? সরসরে ধানের মাঝখান দিয়ে ডিঙি নিয়ে শামুক তুলতে যাইতে মনটা কেমন যেন ছটফট কইরছে। বাপের কুনু বেটা ছাওয়াল না থাকায় নিজেই লাও ঠেলে লিয়ে যাইতে নিজেকে ছেলেই মনে হইতো। বড়োগাঙ হয়ে বিলির মইদ্যি দিয়ে যখুন মাটিগড়ল ধানের স্তুপ ভর্তি আমাগিরি বড়ো লায়ের মাস্তুল ধীরে ধীরে নিকটে আইসতো। বাড়ির ঘাটে বইসি তখুন শরীকের সব ভাইবোন সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দেইখতাম।
আমার শরীরে এখন সাদা কাপড়। দাদীর সাদা কাপড়। সাড়ি সাড়ি সাদা কাপড়। শুয়ে থাকা সাদা কাপড়। হেঁটেচলা সাদা কাপড়। গাড়িতে চড়া সাদা কাপড়। সম্বাদিকের ক্যামেরার সামনে মিথ্যে বলা সাদা কাপড়। আবছা আবছা অন্ধকারের চিবুক ছোঁয়া সাদা কাপড়। সাদা মেঘের মিথ্যে আশ্বাসের মতো সাদা কাপড়। সাদা আসে। আমার খুব মনে পড়ছে মাকে। আমার গলায় ভাঁজ করা দাদীর সাদা কাপড়। বেতের পাতি ভর্তি লালিগুড়ে মাখা শাইলে ধানের মুড়ি খাবো আমি, জামগাছের গোড়ায় বসে। সূর্য উঠবে পুব আকাশের সাদা কুয়াশা ভেদ করে। আমার ক্ষুধা বেড়ে যাচ্ছে। আমার দুই চোখে লক্ষ্মীবিলাস। আমি হাঁসেদের জন্য শামুক কুড়িয়ে ঘৃত করে খাওয়াচ্ছি। আর বড়ো বড়ো শামুকের দুই প্রান্তে ধানের শীষের গোড়ালি রেখে বুড়ি আঙুলের চাপে পুঁচ করে কেটে ডালা ভর্তি করছি। ভাদোই মেলার আগেই আমি টাকা গুছিয়ে রাখবো, লক্ষ্মী আলতা আর হাত ভর্তি রঙিন চুড়ি কিনবো। মাটিগড়ল ধানের স্তুপ থেকে পাহাড়ের অগ্নিগিড়ির মতো ভাপ উঠবে। মলন মলা হবে। জিলিপিওয়ালা আসবে। আমরা ধান বদলে জিলিপি নেব। দাদীর সাদা কাপড় কেন ছাড়ছে না আমাকে? মাটিগড়ল ধানের শীষের ওপর ছোপ ছোপ মেহেদি। ওরা কয় লক্ষ্মীর গু। আমি বলি লক্ষ্মীর মেহেন্দি। আমি দুপায়ে এবং হাতের নখে মেহেদি মাখছি। সাদা কাপড় আমাকে ছাড়ছে না।
আমি ক্রমশঃই আকাশে উঠে যাচ্ছি। প্রথম দফা ডিএনএ টেস্টে আমার নাম নেই। দ্বিতীয় দফা রিপোর্টেও আমার নাম নেই। আমি যে আকাশে উঠে গেছি। ডিএমসির মেডিকেল রিপোর্টে আমি শনাক্ত হলাম। আমার নাম সমাপ্তি। আসলে সমাপ্তি নামের একটি মেয়ে আমাদের সাথে একই ফ্লোরে কাজ করতো। আমার ডিএনএ রিপোর্ট সমাপ্তির নামে। আমি এখন থেকে সমাপ্তি।
আমাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি আজিমপুর কবরস্তানে নেই, আমি জুরাইন কবরস্তানেও নেই। দাদীর সাদা শাড়ি পড়ে আকাশে উড়ে গেছি আমি। আমাকে আর কে পায়? আসলে আমরা যারা হারিয়ে গেছি তাদের কোনো সংখ্যা থাকে না। বিজিএমইএ আমাদের সংখ্যা বলতে পারে না, অর্থমন্ত্রণালয় আমাদের সংখ্যা বলতে পারে না, ডাক্তার আমাদের সংখ্যা বলতে পারে না, নার্স আমাদের সংখ্যা বলতে পারে না, পুলিশ আমাদের সংখ্যা বলতে পারে না। আমি হয়ে গেলাম সমাপ্তি। আমার মা প্রাণে বেঁচে গেছেন তার আদরের ছোটো মেয়েকে নিয়ে। মা রুনা দাস ছোটো মেয়ে প্রীতিসহ সমাপ্তিকে নিয়ে একই ফ্লোরে কাজ করতেন। রানা প্লাজা ধসের দশমাস পরে আমার হদিশ মিললো, সমাপ্তি পরিচয়ে। জুরাইন কবরস্তানে আমাকে খুঁজতে মায়ের সে কী ব্যাকুলতা। মায়ের কপাল মন্দ। কবরে কোথাও আমার পরিচয় নেই। শেষ ভরসা ছিল, কবরের একমুঠো মাটি। যা নিয়ে মা শ্রাদ্ধ-শান্তি করবেন। মায়ের মন। হিন্দুমতে একমাসের মধ্যে শ্রাদ্ধ করতে হয়। ডিএনএ রিপোর্ট এলো দশ মাস পরে। জুরাইন কবরস্তানের একমুঠো মাটি নিয়ে মা ফিরে এলেন। ব্রাহ্মণের পরামর্শমতে তিনদিন ‘নির্জলা উপবাস’ করে চতুর্থ দিনে শ্রাদ্ধের কাজ সারলেন মা। ব্রাহ্মণ ডেকে পূর্ব-পুরুষের স্মরণ করে পিন্ডিদান করা হলো, পরে শ্রাদ্ধের অবশিষ্ট কাজও করা হলো। কবর পাওয়া যায়নি আমার। ডিএমসি ৩১ নামে কোনো কবর জুরাইন কবরস্তানে নেই। তাই আমি একখন্ড ধুলো হয়ে, মায়ের মনের সান্ত¦না হয়ে রয়ে গেলাম। পরঙ্গী ধান আর মাটিগড়লের স্তুপের ওপরে আমি দাঁড়িয়ে আছি, দাদীর সাদা কাপড় আমার পরনে। সাদা পালতোলা আমাদের নৌকাটি নিকটবর্তী। ধান! ধান! আরও ধান। আমার পা জুড়ে লক্ষ্মীর মেহেন্দি।
কনক আমিরুল ইসলাম
সহযোগী অধ্যাপক ,
ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
উপদেষ্টা, উত্তরণ লেখক ও পাঠকের সূতিকাগার।
Leave a Reply