বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞান উৎপাদন ও বিকাশের কেন্দ্র। দক্ষ মানব সম্পদ তৈরির পাশাপাশি জ্ঞান উৎপাদন ও বিতরণ করাই এর প্রধান উদ্দেশ্য। সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা, আড্ডা, আলাপনের মাধ্যমে মুক্ত চিন্তার দ্বার উন্মুক্ত রাখা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম শর্ত। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুসম্পর্কের মাধ্যমে জ্ঞানের আদান-প্রদান ঘটবে এমনটাই প্রত্যাশিত। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা তাদের আহৃত জ্ঞানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিবে, ধাবিত করবে সত্যের পথে। কিন্তু শিক্ষাগুরুই যদি দুর্নীতিপরায়ণ হয় এবং তাদের আদর্শের বিচ্যুতি ঘটে, তাহলে শিক্ষার্থীরা তাদের কাছে কি শিখবে?
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর দিকে তাকালেই দেখা যায় শিক্ষকদের একটা মুনাফালোভী গোষ্ঠীর অসৎ চরিত্রের কারণে পুরো শিক্ষক জাতির ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত সাম্প্রতিক ঘটনার দিকে যদি তাকাই তাহলেই আমরা বিষয়টি সম্পর্কে পরিষ্কার হতে পারবো। প্রায় সাড়ে সাতশো একর জমি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত দেশের ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানটির সাথে আর গুণগত শিক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। চুরি, দুর্নীতি, লুটপাট আর ব্যবসার আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে আমাদের প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়টি। এর নেপথ্যে কাজ করছে কিছু অসাধু, দুর্নীতিবাজ ও সরকারের গোলামী করা শিক্ষক।
কথা হচ্ছে জনগণের টাকায় পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়টির এতো এতো সম্পদ লুটপাট করার জন্য এই তল্পীবাহকদের প্রয়োজন ক্ষমতার। আর সেই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা আছে ভিসির, এই ক্ষমতার সহায়ক হিসেবে যদিও চুরি, লুটপাট করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে আরো কিছু আসন রয়েছে। যেগুলো পূরণ করা হয় ভিসির আশেপাশের মানুষ-জন দ্বারা। মোটাদাগে বললে ভিসির চেয়ারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর এই চেয়ারে যাওয়ার জন্য আমাদের শিক্ষক মহোদয়গণ লিপ্ত হয় অসম প্রতিযোগিতায়। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করার ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয়। কিন্তু তা নামে মাত্র। মূলত ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ দেখা যায়, পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ফলে যে যতবেশি সরকারের তেলবাজি করতে পারবে, সরকারের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে সে ব্যক্তি ভিসি হওয়ার দৌঁড়ে এগিয়ে থাকবে। বাস্তবেও তাই ঘটে। আর যেহেতু ভিসি সরকারের মদদপুষ্ট হয়েই ক্ষমতায় বসে, কাজেই তাকে আর ঠেকায় কে? ফলে খেয়াল খুশি মতো সে সবকিছু করতে থাকে।
ভিসি সাহেব তার দুর্নীতিকে বাস্তবায়ন করার জন্য সরকারি ছাত্র সংগঠনকে কিছু সুবিধা দিয়ে তাদেরকে কাজে লাগান। ফলে ভিসিকে রক্ষার দায়িত্বটা সরকারি ছাত্র সংগঠনটি সুচারুরূপে পালন করে। বদৌলতে তারা পায় চাকরি, টেন্ডার ও হল দখলের এখতিয়ার। বর্তমান সময়ে যেটা ছাত্রলীগ পালন করে যাচ্ছে। আমরা যদি সাম্প্রতিক সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকাই তাহলে বিষয়টা আরো সহজে বুঝতে পারবো। আমাদের ভিসি অধ্যাপক ড. আব্দুস সোবহান সাহেব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এডহক নিয়োগ দিতে চাইলে দুর্নীতি বিরোধী শিক্ষকরা প্রতিবাদ জানিয়ে ভিসির সাথে ভিসির বাড়িতে দেখা করতে যায়। কিন্তু ছাত্রলীগ গেটের সামনে বাধা প্রদান করে তাদের পথ আটকিয়ে দিলে সেখানে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে স্থানীয় ছাত্রলীগের এক নেতা শিক্ষকদের গুলি করার হুমকি দেয়। যদিও ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে এরচেয়ে ভালোকিছু আমরা আশা করতে পারিনা। কিন্তু ছাত্রলীগ ভিসির পথ আটকালো কেন?
তার উত্তর খুব সহজ। ভিসি সাহেব যে নিয়োগ দিতে চেয়েছে সেই নিয়োগের চাকরী প্রার্থী এই ছাত্রলীগের নেতারা। আর তাদের সাথে ভিসির লেনদেনের কথা আমরা লোকমুখে শুনেছি বেশ কয়েকবার। যেটাকে আমরা একেবারে অসত্য বলতে পারিনা। কারণ এই উপাচার্য মহোদয়ের দুর্নীতির কথা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। ২০১৯ সালে একজন গোল্ড মেডেলিস্ট ছাত্রকে চাকরি দেওয়ার জন্য তার কাছে প্রো-ভিসি অধ্যাপক চৌধুরী মুহাম্মদ জাকারিয়ার টাকা চাওয়ার অডিও ক্লিপ ফাঁস হলে সারা ক্যাম্পাসে হৈচৈ ওঠে। আমরা প্রমাণিত দুর্নীতিবাজ ওই প্রো-ভিসির অপসারণ দাবি করলেও ভিসি সাহেব কোন পদক্ষেপ নেয়নি। কারণ ভাগ-বাটোয়ারার বিষয় তো থাকেই। সেই ছাত্রটি টাকা দিতে না পারায় তার চাকরি হয়নি। কিন্তু ভিসির মেয়ে ও তার জামাতার যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও চাকরি পায়। যেন বিশ্ববিদ্যালয়টি ভিসির বাপের কেনা সম্পদ। সে তার খেয়াল-খুশি মতো সব করবে। এখানেই তার ছলচাতুরীর শেষ না। রাষ্ট্রপতিকে মিথ্যা বলে অবসর গ্রহণ, উপাচার্যের বাড়ি ভাড়া নিয়েও দুর্নীতির তথ্য জানিয়েছে ইউজিসি।
বাংলাদেশ যেমন একটি রাষ্ট্র তেমনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে একটি মিনি রাষ্ট্র। বর্তমান অবৈধ সরকার ও তার এমপি মন্ত্রীরা যেমন উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিত রাস্তা-ঘাট, ইমারত আর ফ্লাইওভার তৈরী করে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাজেট বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করে। রডের বদলে বাঁশ দিয়ে জনগণকে বুড়ো আঙ্গুল দেখায় ঠিক এভাবেই উপাচার্য মহোদয় ও তার প্রশাসন বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প হাতে নিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা লোপাট করে। যা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি।
আমরা এও দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছ কেটে বিশ্ববিদ্যালয়কে মরুভূমি করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে রাবি প্রশাসন। তাদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে উত্তম ব্যবসা ক্ষেত্র। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়াম, টিএসসি, ক্যাফেটেরিয়া সবই ভাড়া দিয়ে টাকা কামাচ্ছে। শুধু তাই নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি, ফলের গাছ, পুকুর লিজ দিয়ে নিজেদের পকেট ভরছে। যদিও এসব ব্যবহারের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অধিকার সবচেয়ে বেশি। ছাত্ররা বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ প্রোগ্রামের জন্য একটা হলরুম পায়না, কিন্তু প্রশাসন বেশি টাকার আশায় বহুজাতিক কোম্পানির কাছে ভাড়া দেয় প্রোগ্রামের জন্য।
আরেকটা লজ্জাকর ঘটনা না বললেই নয়। বছর দুয়েক পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমের গাছের আম পাড়ার কারণে একজন ছাত্রকে পুলিশে দিয়েছিল প্রো-ভিসি ড. আনন্দ কুমার সাহা।
এই হচ্ছে আমাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা। শুধু এই ভিসি বা বর্তমান প্রশাসনই নয় বিগত সময়ের ভিসির ক্ষেত্রেও এমন চিত্র আমরা দেখেছিলাম। তারাও বিশ্ববিদ্যালয়কে টাকা কামানোর যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। ২০১৪ সালের ঘটনা দেশবাসী এখনো ভোলেনি। তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক ড. মিজানউদ্দিন সাহেবের সময় বিভিন্ন বিভাগে বেতন ফি বৃদ্ধি ও বাণিজ্যিক সান্ধকোর্স ব্যাপকহারে চলতে থাকে। এরই প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী আন্দোলনে নামে।
ভিসির মদদে তৎকালীন প্রক্টর, ছাত্রলীগ ও পুলিশ শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায় এবং গুলিবর্ষণ করে। কিন্তু তাতেও আন্দোলন থামাতে ব্যর্থ হলে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র নেতা গোলাম মোস্তফা, উৎসব মোসাদ্দেক, আহসান হাবীব রকি, ফারুক ইমনসহ রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মী ও শিক্ষার্থীদের উপর মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। সেই মামলার ঘানি এখনো তাদেরকে টানতে হচ্ছে। এই হচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাধর কতিপয় মুনাফালোভী শিক্ষকদের চরিত্র। তাদের টাকা কামানোর ব্যস্ততায় ধরাশায়ী শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ। ভেঙ্গে পড়েছে শিক্ষাব্যবস্থা।
আপনারা হয়তো এখন ভাবছেন এর পরে অন্য কেউ ভিসির চেয়ারে বসলে সেও তাই করবে? জি, আপনার ভাবনা সত্য। সেও লুটপাটতন্ত্রের সাথে যুক্ত হবে। কারণ তো আগেই বলেছিলাম, ভিসিরা সরকারের মদদপুষ্ট হয়ে সর্বোচ্চ ক্ষমতা নিয়ে এই চেয়ারটি দখল করে। ফলত সে অতি ক্ষমতার দরুণ স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। কাউকে তার কাজের জবাবদিহি করতে হচ্ছেনা। তার পরবর্তী তিন প্রজন্মের বিলাসী জীবনের জন্য জারি রাখে তার লুটপাটতন্ত্র। যদি আজকে ৭৩ এর এ্যাক্ট অনুযায়ী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন দ্বারা পরিচালিত হতো, তাহলে ভিসি এভাবে স্বৈরাচারী, দুর্নীতিপরায়ণ ও মুনাফালোভী হতে পারতো না। রাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে যদি ছাত্র প্রতিনিধি ও রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট নির্বাচনের মাধ্যমে গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধিসহ সকল সিনেট সদস্য দ্বারা সিনেট পূর্ণাঙ্গ থাকতো, তাহলে ভিসি তার কাজের জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকতো অথবা তাকে বাধ্য করানো হতো। যার ফলে কমে আসতো দুর্নীতি ও লুটপাট।
চলমান কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘদিনের এই সংকট দূর করা যাবেনা। এই সংকট নিরসনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভিসি নির্বাচন করতে হবে। রাকসু নির্বাচন ও রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট নির্বাচনের মাধ্যমে সিনেট পূর্ণাঙ্গ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তবেই আমরা দুর্নীতি, লুটপাট ও গুণ্ডাতন্ত্রের বাইরে গিয়ে একটি শিক্ষাবান্ধব গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাস বিনির্মাণ করতে পারবো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাই, বন্ধুরা এ ক্যাম্পাস আপনার, আমার সকলের। আমরা শিক্ষার্থীরাই এ ক্যাম্পাসের প্রধান চালিকা শক্তি। নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এবং শিক্ষক রাজনীতির কামড়াকামড়ি থেকে আমাদের প্রিয় মতিহারের সবুজ চত্বরকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে।
মহব্বত হোসেন মিলন
সম্পাদক, উত্তরণ সাহিত্য পত্রিকা
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Reply