হক-কথার প্রথম সংখ্যার লিড নিউজ ছিল এরকম। প্রকাশিত হয়েছিল ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২। তবে’র ব্যাখাটি ছিল এরূপ- “ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বাস করেন যে পার্লামেন্টারি পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্র কায়েম সম্ভব হইবে। যদি তাহাদের বক্তব্য বাস্তবে প্রমানিত হয় তবে নিঃসন্দেহে সারা দুনিয়ায় একটি নতুন আবহাওয়া প্রবাহিত হইবে। এমতাবস্থায় আমাদের অপেক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করা উচিত। তাই আওয়ামী লীগ সরকারকে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা- এই তিনটি কর্মসূচী বাস্তবে রূপায়িত করিতে সময় প্রদান করা হউক।” হক-কথার প্রথম সংখ্যার এই খবরটি থেকেই এর গতিপ্রকৃতি খানিকটা অনুধাবন করা যায়; সেই সাথে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর রাজনীতির গতিধারাও।
১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি মওলানা ভাসানী ভারত থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। সন্তোষে তিনি প্রথম রাত্রি কাটান মাটির বিছানায়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দুরদর্শী ভাসানী দেশের আসন্ন অরাজক পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরেছিলেন। এহেন পরিস্থিতিতে তিনি তাঁর দুইমূখী সংগ্রাম অর্থাৎ বিদ্রোহ আর শোধনের অংশ হিসেবে রাজনীতির পাশাপাশি হক-কথা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ইতিপূর্বে তিনি ১৯৪৬ সালের দিকে প্রথমবার আসাম থেকে ‘হক কথা প্রচার’ বুলেটিন আকারে প্রকাশ করেছিলেন। এরপর পাকিস্তান আমলের শুরুতে টাঙ্গাইল থেকে এবং ১৯৬৭-৬৮ সালে মহীপুরের হক্কুল এবার মিশন থেকেও তিনি এই প্রচার বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন। এছাড়া জানা যায়, ১৯২০ সালের দিকে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী দল ‘অনুশীলন সমিতি’-র অন্যতম নেতা পুলিন বিহারী দাসও হক কথা নামে স্বল্পকালস্থায়ী একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। যার সম্পাদক ছিলেন নলিনী কিশোর গুহ।
প্রকাশনার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই মওলানা ভাসানীর ‘হক কথা’ একটি আঞ্চলিক পত্রিকা থেকে জনপ্রিয়তা ও প্রচার সংখ্যার মানদন্ডে দেশব্যাপী শীর্ষস্থানীয় সংবাদ সাপ্তাহিকী হয়ে উঠেছিল। শুধু বিষয়বস্তুর দিক থেকেই নয়, হক-কথার বিন্যাস-ব্যাসনেও ছিল অভিনবত্ব। বিশেষ করে স্যাটায়ার প্রকাশে এর কার্টুনের ব্যবহার সেই সময়ের পত্রিকা জগতে ছিল নতুন সংযোজন
আট পৃষ্ঠার সাপ্তাহিক হক কথা ট্যাবলয়েড সাইজের নিউজপ্রিন্ট কাগজে লেটার প্রেসে ছাপা হতো। পত্রিকাটির ডিক্লারেশন শান্তি প্রেস, সন্তোষ, টাঙ্গাইল-এর নামে থাকলেও এর প্রথম চারটি সংখ্যা বুলবুল খান মাহবুবের কল্লোল প্রেস, টাঙ্গাইল হতে ছাপানো হয়েছিল। পঞ্চম সংখ্যা হতে যথারীতি শান্তি প্রেস ও কল্লোল প্রেস থেকে ছাপা হতে থাকে।
মওলানা ভাসানীর জীবদ্দশায় ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সাল থেকে ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ সাল ৩০তম সংখ্যা পর্যন্ত (নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় পূর্ব পর্যন্ত) এবং ১২ জানুয়ারি ১৯৭৬ সাল থেকে ১৪ নভেম্বর ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ৪০টি সংখ্যাসহ সর্বমোট ৭০তম সংখ্যা হক কথা প্রকাশিত হয়েছিল। এবং তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৭৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৮ সালের ০১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৯টি সংখ্যাসহ সর্বমোট ৯৯টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই মওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর হক কথা তার জৌলুস ও গুরুত্ব প্রায় হারিয়ে ফেলে। অনেকের মতে, এসময় হক কথা কেবল পুনঃর্মুদ্রণ ও চর্বিত চর্বন রূপে যেন এর ঐতিহাসিক প্রয়োজন হারিয়ে ফেলেছিল।
২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ সালে নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় পূর্ব পর্যন্ত হক কথা-র প্রচার সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ। কারো কারো মতে টাঙ্গাইলের পাশাপাশি ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ কয়েকটি অঞ্চল থেকে একযোগে হক কথা প্রকাশিত হতো। প্রকাশনার শুরুতে সম্পাদক সৈয়দ ইরফানুল বারী, কবি বুলবুল খান মাহবুব, মোহাম্মদ হোসেন এবং পরবর্তীতে শাহ আহমদ রেজা, অধ্যাপক শামসুল আরেফিন, নাজিমউদ্দিন মোস্তান, আবদুর রহিম আজাদ, আঃ মতিন, বাহার, বলরাম সাহা, প্রেস ম্যানজার আব্দুর রহমান প্রমূখদের নিয়ে একটি দক্ষ টিম গড়ে ওঠে। এ সময় কমপক্ষে পনের হাজার সংবাদকর্মী সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে হক কথার সাথে সংযুক্ত ছিল বলে জানা যায়।
সাপ্তাহিক হক কথায় চলমান খবরের পাশাপাশি ভিউজ বেশি প্রাধান্য পেত। তৎকালীন প্রেক্ষাপটে তথ্যের অবাধ প্রবাহের অভাব, শাষক শ্রেণীর নানারকম বিধি নিষেধ, দমন পীড়ন, হয়রানির সাথে সাথে গুজবেরও প্রতুলতা ছিল। এরই মাঝে হক কথায় প্রকাশিত তথ্য ও প্রতিবেদনে এর প্রভাব পরা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু হক কথা তার বস্তুনিষ্ঠতায় কখনো আপোষ করেনি। সবিশেষ একথা প্রণিধেয় যে, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে দেশ ও জাতির নয়া ক্রান্তিকালে মওলানা ভাসানী এবং তাঁর প্রকাশিত হক কথার ভূমিকা ইতিহাস স্বীকার্য।
আজাদ খান ভাসানী
সদস্য সচিব, ভাসানী পরিষদ
সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষক সমিতি
Leave a Reply